ফুটফুটে সুন্দর একটি মেয়ে, নাম মেঘলা খাতুন (১৩)। বাবা-মায়ের কোল আলো করে সে যখন পৃথিবীতে আসে, তখন তাদের পরিবারে বইছিল অপরিসীম আনন্দ আর সুখের ফল্গুধারা। স্বজনরা ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন মেঘলা।
কিন্তু কে জানতো নামের মতোই কালো মেঘের অমানিশায় ঢাকা পড়বে ছোট্ট কিশোরী মেঘলার জীবনের সুখের সোনালী রোদ্দুর। এখন যে সময়ে তার মন দিয়ে পড়াশোনা করার কথা, সে সময়ে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ।
যে বয়সে হাসি আনন্দে ছুটে বেড়ানোর কথা, তখন সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে পথে পথে ঘুরছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। জেলার লালপুর উপজেলার বেলগাছি গ্রামের কসমেটিক্স ব্যবসায়ী মিন্টু মন্ডলের মেয়ে মেঘলা বড়াইগ্রামের মাঝগাঁও দক্ষিণপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।
স্থানীয়রা জানায়, শুক্রবার বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া পৌরসভার মালিপাড়া বাজারে বসে কাঁদছিল মেঘলা। এ সময় কিছু লোক বিষয়টি দেখে তার কাছ থেকে ঠিকানা জেনে বাড়িতে খবর পাঠালে মেঘলার বাবা-মা সেখানে আসেন। এ সময় তারা তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যেতে না চাইলে বাজারের মধ্যেই মেঘলাকে চড় থাপ্পড় মারেন তারা। কিন্তু শিশু মেঘলা স্থানীয় লোকজনের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকে বাড়িতে না পাঠানোর জন্য। আর জোর করে বাড়িতে পাঠালে সেখানে গিয়ে সে আত্মহত্যা করবে বলেও জানায়।
সে আরো জানায়, অসুস্থ বাবার সঙ্গে থাকা মানুষটি তার সৎ মা। সৎ মায়ের নির্যাতন থেকে রেহাই পেতেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাড়ি থেকে পালিয়েছে সে।
এলাকাবাসী জানায়, প্রথম স্ত্রী ঈশ্বরদীর জয়নগর এলাকার শিউলী খাতুন আর মেয়ে মেঘলাকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল মিন্টু মন্ডলের। কিন্তু প্রায় ৮ বছর আগে মেঘলার পিতা বনপাড়া সরদারপাড়ার দুলাল হোসেনের মেয়ে শাহিনা খাতুনকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেন। সুখের সংসারে নেমে আসে অশান্তি আর কলহ। বছর তিনেক আগে মেঘলা খাতুনের মা শিউলী খাতুন ও তার পিতার মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর শিউলী খাতুন চলে যান বাবার বাড়ি, মেঘলা রয়ে যায় তার পিতা আর সৎ মায়ের সংসারে।
৫ মাস আগে মেঘলার মা শিউলী খাতুনেরও আবার বিয়ে হয় পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার জিগিরতলা এলাকায়। এভাবেই মা হারা শিশু মেঘলার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। আপন মা বাড়ি থেকে যাওয়ার পর শিশু মেঘলার সৎ মা শাহিনা খাতুন মেঘলার উপর নানামুখী অত্যাচার শুরু করেন।
এক পর্যায়ে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেন এবং বাল্য বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ছোট্ট মেঘলা উপায়ান্তর না পেয়ে শুক্রবার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু মালিপাড়া বাজার পর্যন্ত এসে এবার কার কাছে যাবে বুঝতে না পেরে শুরু করে কান্নাকাটি। এরপরই বিষয়টি লোকজনের নজরে আসে।
বাবা আর সৎ মায়ের সঙ্গে যেতে রাজি না হওয়ায় স্থানীয়রাও পড়েন বিপাকে। পরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মালিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মতিউর রহমানের (৪৫) কাছে আশ্রয় চাইলে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় তিনি মেঘলাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে রেখেছেন।
এ ব্যাপারে মেঘলার মা শিউলী খাতুন মোবাইলে জানান, মেয়েটার উপর অত্যাচার করছে শুনে খুবই খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি নিজেই অন্যের সংসারে আছি, আমিইতো নিরুপায়। এরপরও দেখি কি করা যায়।
বনপাড়া পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আশরাফুল ইসলাম বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, নিজেদের দ্বন্দ্বে স্বামী-স্ত্রী পৃথক হয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে শিশু সন্তানরা। তাই নিজেদের সুখের জন্য বিবাহ-বিচ্ছেদের আগে সন্তানদের ভবিষ্যতটাও চিন্তা করা উচিৎ।
বড়াইগ্রাম থানার ওসি আবু সিদ্দিক জানান, মেয়েটি তার মায়ের কাছে যেতে চায়। কিন্তু নানা জটিলতায় সেটা সম্ভব না হওয়ায় শুক্রবার রাতে আপাতত তাকে দাদা-দাদির জিম্মায় দেওয়া হয়েছে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।